আমার জন্ম গ্রামে। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে ওখানেই। দল বেঁধে বড় বড় জঙ্গলের পাশ দিয়ে ঢাকা-হালুয়াঘাট সড়কের পাশে কাকনী প্রাইমারি স্কুলে যেতাম। হাইস্কুলেও একই পথ দিয়ে গিয়েছি। জঙ্গলের নাম না–জানা গাছগুলোকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। অনেক সময় একাও যেতে হতো। সে সময় বই বুকে জড়িয়ে ধরে দিতাম দৌড়। জঙ্গল পার হয়ে তবেই হাঁপ ছেড়ে বাঁচতাম।
বসন্তে-গ্রীষ্মে জঙ্গলের বনজামগাছে ফল পেকে প্রথমে হলুদ, পরে কালো রঙের হতো। স্কুল থেকে ফেরার পথে দল বেঁধে জঙ্গলে ঢুকে পাকা বনজাম খেতাম। অনেক দিন একাও ডরভয় তুচ্ছ করে বনজাম খাওয়ার জন্য জঙ্গলে ঢুকেছি। চৈত্রসংক্রান্তিতে বিভিন্ন ফুলবাহী, ফলবাহী বুনো গাছের ডাল দিয়ে বাড়ির গোয়ালঘর সাজানো হতো। বাড়ির কাজের ছেলের সঙ্গে আমিও ওগুলো সংগ্রহ করতে যেতাম। কাজের ছেলের কাছেই অনেক বুনো উদ্ভিদের স্থানীয় নাম জেনেছিলাম। গোয়ালঘর সাজানোর অন্যতম উপকরণ ছিল বনজামের ফুল ও ফলবাহী শাখা
ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদীর তীরে পুষ্প, বৃক্ষ, লতাগুল্মে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন। গত ২৬ অক্টোবর ২০২৪ হেমন্তের এক বিকেলে গিয়েছিলাম সেখানে। ওখানকার পুকুরপাড়ের ছোট এক মাঠের ধারে দেখা পেলাম বনজামগাছের সারির। গাছে দেখা পেলাম ফুল ও কাঁচা-পাকা বনজামের। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার কথা। বনজাম সাধারণত বসন্তে, গ্রীষ্মে পাকে। অথচ এখানে পাকা ফল পেলাম হেমন্তে। ফলের ওপরের কালো পাকা আবরণ খাওয়া যায়। খেয়ে দেখলাম কয়েকটা।
বনজাম চিরসবুজ উদ্ভিদ। এই গাছ ১.৫ থেকে ৪ মিটার পর্যন্ত উঁচু হতে পারে। এর শাখাগুলো সাধারণত লাল রঙের হয়। বাকল মসৃণ ও বাদামি। এর বৈজ্ঞানিক নাম Ardisia solanacea, এটি Myrsinaceae পরিবারের উদ্ভিদ। এই উদ্ভিদ ইংরেজিতে Shoebutton Ardisia নামে পরিচিত। ফলের আকৃতির জন্য পাতা অখণ্ড, ডিম্বাকার, উপবৃত্তাকার, চামড়ার মতো। পাতা ১০-২০ সেন্টিমিটার লম্বা হতে পারে। পাতা চকচকে এবং বড়। পাতার সামনের দিক তীক্ষ্ণèএবং নিচের দিক ক্রমশ সরু, দৈর্ঘ্যে প্রায় ১৪-২০ সেন্টিমিটার। পাতার বোঁটা খাটো, ১ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। পুষ্পবিন্যাস দূরবর্তী, কাক্ষিক, অনিয়ত, করিম্বের মতো রেসিম। মঞ্জরিদণ্ড ১০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুল গোলাপি বা গোলাপি-সাদা, তারকা আকৃতির এবং ১.৫ থেকে ২ সেন্টিমিটার প্রশস্ত। ফুলের বোঁটা ১.৫ সেন্টিমিটার লম্বা। বৃত্যংশ পাঁচটি, চামড়ার মতো, স্থায়ী। পাঁচটি পাপড়ি বিন্দু বিন্দু দাগবিশিষ্ট, ডিম্বাকার, চামড়ার মতো। পাপড়ি বাইরের দিকে ছড়ানো, যুক্ত হয়ে দলনল গঠন করে। ফুলে পুংকেশর পাঁচটি—গর্ভদণ্ডের চারপাশ ঘিরে অবস্থিত, বাইরের দিক উন্মুক্ত। গর্ভাশয় গোলাকার, অসংখ্য ডিম্বক, গর্ভদণ্ড খাড়া। বেরিজাতীয় ফল। এর ব্যাস ৭ থেকে ১৩ মিলিমিটার। ফল পরিপক্ব অবস্থায় কালো, রস গোলাপি রঙের।
বনজামগাছ বনের ধারে ছায়াযুক্ত স্যাঁতসেঁতে স্থানে জন্মে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ঢাকা, টাঙ্গাইল, দিনাজপুর, শেরপুর, বাগেরহাট, খুলনা, কুড়িগ্রামের ছোট-বড় এবং চিরসবুজ বনে বনজামের গাছ পাওয়া যায়। অনেকে শখ করে এর সুন্দর গোলাপি ফুলের জন্য বাগানে লাগায়। প্রায় পুরো ভারতে এই উদ্ভিদ আর্দ্র গিরিখাত এবং বনের অধিবাসী। একে হিমালয়ে, কুমায়ুন থেকে সিকিম পর্যন্ত ২০০-১১০০ মিটার উচ্চতায় পাওয়া যায়।
বনজামের কিছু ভেষজ গুণ রয়েছে। এর শিকড় জ্বর, হজমে সহায়ক, ডায়রিয়া, মানসিক সমস্যা, মাথা ঘোরানো, গেঁটে বাতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। মূলে ব্যাকটেরিয়াপ্রতিরোধী উপাদান রয়েছে। বনজামের ফল হলুদ রং তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এই রং কাগজের ওপর বাদামি রং ধারণ করে।








